ধুয়া

১।

অনেক দিন আগের কথা। তখন যশোরের ডুমুরখালী গ্রামটায় সন্ধ্যা নামলে মাঠের ধারে লণ্ঠন জ্বলে উঠত, আর হাটফেরত মানুষদের হাসি-মশকরায় গ্রাম ভরে যেত। সেই গ্রামেই বাস করতেন ইউসুফ মোড়ল — গ্রামের অভিভাবক, বিচারক, মধ্যস্থতাকারী। কারো ঝগড়া, কারো জমি নিয়ে ঝামেলা, কারো পরিবারের অভিমান — সব কিছুর মীমাংসা করতেন তিনি। লোক বলত, “যে ইউসুফ মোড়লের দরজায় যায়, সে খালি হাতে ফেরে না।”

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইউসুফ মোড়লের মনে অদ্ভুত এক পরিবর্তন আসতে লাগল। মানুষের দুঃখ-কষ্ট মেটাতে মেটাতে নিজের ভিতর যেন এক শূন্যতা জমতে লাগল। একদিন বিকেলে, ডুমুরখালীর বটতলায় একা বসে থাকতে থাকতে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন,

“এই যে এত কথা বলি, এত বিচার করি — কিন্তু আমার মনের কথা কে শুনে?”

তারপর থেকে তিনি গুনগুন করে গান রচনা করতে লাগলেন। গ্রামের মানুষ অবাক — একসময়ের কঠিন বিচারক এখন গান গায়! কিন্তু সেই গানগুলো ছিল না কোনো তুচ্ছ গানের মতো। সেগুলোর ধুয়ায় ছিল গভীর ব্যথা, মাটির গন্ধ, আর মানুষের জীবনের সারাংশ।

গ্রামের ছেলেরা বলত,

“মোড়ল দাদার ধুয়া উঠলেই মনে হয় বুকটা কেমন হালকা হয়ে যায়।”

সেই “ধুয়া” — শব্দটা ছিল গ্রামের নিজস্ব ভাষা। পরে কেউ কেউ বলেছিল, “ওটাই তো আসলে গানের হুক — যে অংশে গান ধরে রাখে মন।” কিন্তু ইউসুফ মোড়লের কাছে ধুয়া ছিল প্রার্থনার মতো — তার জীবনের জমে থাকা নিঃশ্বাস।

বছর কেটে গেল। ইউসুফ মোড়ল ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন সময়ের কুয়াশায়। তার গানও কোনো খাতায় লেখা হয়নি, কোনো রেকর্ডারে ধরা পড়েনি। শুধু মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেছে কিছু ছেঁড়া লাইন, কিছু সুরের টুকরো।

১৯৮৮ সালে, এক তরুণ — ইউসুফ মোড়লের নাতি — সেই গানগুলোর খোঁজে ফিরে এল গ্রামে। গ্রামবাসীদের কেউই ঠিকভাবে মনে করতে পারল না সব কথা, কিন্তু এক বৃদ্ধা বললেন,

“বাবা, তার গানের ধুয়াটা ছিল এমন, শুনলে মনে হতো কেউ আপনাকে বুঝে ফেলেছে।”

তরুণটি আকাশের দিকে তাকাল। দূরে কোথাও পাখির ডাক ভেসে এলো। মনে হলো, বাতাসে এখনো লেগে আছে সেই ধুয়ার শব্দ—

যে শব্দ ছিল এক মোড়লের অন্তর থেকে জন্ম নেওয়া গানের প্রতিধ্বনি।

২।

বছরটা ১৯৮৮। গ্রীষ্মের শেষে বৃষ্টি নামার ঠিক আগে, ইউসুফ মোড়লের নাতি শহর থেকে ফিরেছিল ডুমুরখালী গ্রামে। হাতে পুরনো এক খাতা, ভেতরে কেবল কয়েকটা খালি পৃষ্ঠা। মন চায়, সেই খাতায় লিখে রাখবে দাদার গান।

গ্রাম তখন অনেক বদলে গেছে। পাকা রাস্তা, নতুন ঘর, কিন্তু মানুষের মুখে এখনো মাটির গন্ধ লেগে আছে। গ্রামের এক বৃদ্ধা বললেন,

“তোমার দাদার গান মনে আছে, বাবা। উনি গাইতেন নদীর ধারে বসে, কেমন এক টান ছিল কণ্ঠে। গানের ধুয়া শুরু হতো এইভাবে—

‘যে মনেতে বেদনা থাকে, সেই মনেতে গান জাগে…’”

নাতির বুক কেঁপে উঠল। যেন হঠাৎ সময় থমকে গেল।

সে খাতার প্রথম পাতায় লিখল লাইনটা—

“যে মনেতে বেদনা থাকে, সেই মনেতে গান জাগে।”

তারপর দিন কেটে গেল, সন্ধ্যায় নদীর ধারে বসে সে নিজেই গাইতে লাগল সেই ধুয়াটা। ধীরে ধীরে নিজের ভাষায় কিছু শব্দ যোগ করল, কিছু সুর বাঁধল নিজের মতো করে। যেন হারিয়ে যাওয়া সুরের উপর নতুন আলো পড়ল।

এক রাতে ঝড় উঠল। খাতাটা উড়ে গেল জানালা দিয়ে, ভিজে গেল বৃষ্টিতে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সেই সুর আর হারাল না। পরদিন সকালে গ্রামের ছেলেমেয়েরা হাঁটতে হাঁটতে শুনল, নাতি গাইছে নদীর ধারে—

“যে মনেতে বেদনা থাকে, সেই মনেতে গান জাগে,

দাদার ধুয়া এখনো বাজে, হাওয়ার মতো লাগে…”

বৃদ্ধা চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনলেন। তার চোখে জল।

“দেখো বাবা,” তিনি বললেন, “ধুয়া কেউ লেখে না, ওটা মন থেকে আসে। তোমার দাদা চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর ধুয়া তোমার গলায় বেঁচে আছে।”

নাতি তখন আকাশের দিকে তাকাল। মেঘের ফাঁকে সূর্য উঠছে, পাখিরা ডাকছে। মনে হলো, ইউসুফ মোড়লের সেই গান বাতাসে আবার ভেসে বেড়াচ্ছে। শুধু শব্দ নয় — সেটা যেন এক উত্তরাধিকার, এক রক্তের স্মৃতি, এক মাটির প্রতিধ্বনি।

Copyright © 2025 Note | Audioman by Catch Themes