সূর্যগ্রহণ, ১৯৯৬: সালাম বরকত হলের ছাদ
১৯৯৬-এর সেই গ্রীষ্মের দুপুরে, আমরা ছিলাম সালাম বরকত হলের ছাদে, সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সালাম, বান্না, গোরং আর আমি—আমাদের সবাইকে ঘিরে ছিল গ্রহণের মোহময় মুহূর্ত। বাতাসে সিগারেট আর সালামের এনে দেওয়া একটি বিশেষ সিগারেটের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছিল, আমাদের হাসি-কথার মধ্যে দিয়ে ধোঁয়া যেন ধীরে ধীরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছিল। ওপরে, চাঁদ আস্তে আস্তে সূর্যের উপর চলে আসছিল, আমাদের পৃথিবীকে ঢেকে দিচ্ছিল এক দীর্ঘ ছায়া।
তুমি সেখানে ছিলে না, ছাদে ওঠার অলিখিত নিয়মের জন্য, যা ছেলে বন্ধু দের সাথে মেয়ে বন্ধুদের যোগদানে বাধা সৃষ্টি করছিল। কিন্তু তোমার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলাম, আকাশের দিকে তাকিয়ে, ভাবছিলাম হয়তো তুমি কোনো দূরের ছাদ থেকে একই গ্রহণ দেখছো, একই উত্তেজনা।
“তাকে কি এখানে আনা যেতো না?” সালাম মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো, চোখে তার স্বভাবসিদ্ধ ঝাপসা দৃষ্টি।
“এখানে?,” আমি বললাম, “কিভাবে?? আমরা এই বাঁধাগুলো অতিক্রম করবো! নীরবতায় হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। ব্রুটাস, সাচ এন অ্যাস।
গো রং হাসলো, তার চিরপরিচিত দুষ্টুমি ভরা হাসিতে। “এটাই ভালোবাসার জাদু, বন্ধু! সে তো তোমার প্রহরী হয়ে গেছে! ভাবছি এটাই গ্রহণের সবচেয়ে বড় রহস্য। একসময় দেখবে পুরো ছাদে তার নাম ধরে চিৎকার করছো।”
বান্না হেসে, আকাশের দিকে মুখ তুলে কিছু লাইন আবৃত্তি করলো, যা সেই মুহূর্তের মাধুর্যকে আরো গভীর করলো—
“এই রসিক পথে বন্ধু, সময়ের বন্ধনে,
ছায়াতে আলো যেন এক হয়ে যায়…”
তার কথার সাথে সাথে আমরা এক স্নিগ্ধ, গভীর কণ্ঠস্বর শুনলাম, যা আমরা ভাবতেই পারিনি। ঘুরে দেখি, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ, রূপসী বাংলার কবি। তার গভীর চোখ আর মৃদু হাসি, এই সন্ধ্যার ছায়ার মধ্যে তিনি নিজেই আবির্ভূত হয়েছেন।
“জানো,” তিনি বললেন, “গ্রহণ আসলে কোনো বাধা নয়; এটা মিলন। ছায়া আর আলো একে অপরকে জানতে আসে, প্রেমিক-প্রেমিকার মতো।”
বান্না আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “জীবনানন্দ ঝরা পাতা কাব্যের কবি – নিজে এখানে! বলা হয় কিছু সম্পর্ক মাত্র বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, আর প্রেমের সীমা তো আরও বেশি।”
জীবনানন্দ মৃদু হাসলেন, তার দৃষ্টি আমার উপর পড়লো, যেন তিনি আমার নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষা অনুভব করতে পারছেন। “আহা, কিন্তু এই সীমা নির্ধারণ করে কে? শুধু কিছু ছায়া যা আমরা নিজেদের আর হৃদয়ের মাঝে রাখি। সমাজের নিয়মগুলো, প্রত্যাশাগুলো— সাময়িক গ্রহণ মাত্র। কিন্তু গ্রহণ শেষ হয়, আর যে জিনিস অবশিষ্ট থাকে তা হলো আলো।”
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটির কথা হয়। তার কথাগুলো আমার গভীরে প্রবেশ করলো, যেন একটি অন্ধকার ঘরে আলো এসে পড়লো। জীবনানন্দ’র উপস্থিতি যেন আমার চোখের সামনে বন্ধনগুলো খুলে দিলো, বুঝিয়ে দিলো যে ভালোবাসা কোনো নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার বাইরেই তার অস্তিত্ব, যেমন তুমি সেই ছাদের বাইরে থেকেও আমার হৃদয়ের মাঝে ছিলে।
সূর্যগ্রহণ, ২০২৪: নিউ ইয়র্কে কান্ট্রি ক্লাব হাউজ ডেক
বছরের পর বছর কেটে গেছে। এখন আমি আর সেই পুরনো ছাদে নেই; আমরা নিউ ইয়র্কে, আমাদের বাড়ির ঝুলন বারান্দায়; ব্যাকয়ার্ড এ লম্বা পাইন গাছ আর ইস্টার্ন রেড বাড গাছের ছায়ার মধ্যে। জাবি’র ইউক্যালিপ্টাস, জারুল, কৃষ্ণচূড়া থেকে অনেক দূরে। তবু দূরে নেই, নিয়মের আড়াল নেই। আমার পাশে বন্ধু, ভালোবাসা, সঙ্গী। কিন্তু আকাশ অন্ধকার হতে শুরু করতেই সেই পুরনো মুহূর্ত যেন কাছে চলে আসে, সালাম, বান্না, গোরং আর রুমী—তাদের কণ্ঠস্বর যেন এখানেও শুনতে পাই, ঠিক যেমন শুনেছিলাম সালাম বরকত হলের সেই ছাদে।
ঠিক আছে, গ্লাস পর তো; নিরাপত্তা আগে! একটা গ্যাসের গোলা আরেকটা গ্যাসের গোলার উপর যাইয়া পড়বে, দৃশ্য দেখতে গিয়ে অন্ধ হতে চাই না।
আরে, আমরাও আসলে গ্যাসের থলে। মহাকাশের গ্যাসের গোলার দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি বরং বেশ সূক্ষ্ম কণার একগুচ্ছ।
আমিও গ্যাস হলে হিলিয়াম হতাম—কারণ আমি পিচ্চি আর হালকা!
হাইড্রোজেন, কারণ তুই খুব সহজেই জ্বলে উঠতে পারিস।
ওয়াও, দেখো! শুরু হয়ে গেছে! সূর্য জানে যে আমরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছি?
অবশ্যই জানে। লজ্জা পাচ্ছে
প্রাচীন মানুষজন ভাবতো এটা একটা মহাজাগতিক ব্রেকআপ? সূর্য আর চাঁদের একটু ঝগড়া হচ্ছে।
চাঁদ বলছে, ‘ব্যস, এবার শেষ।’ আর সূর্য পিছনে পিছনে, ‘না, না, ফিরে এসো!’ বলতে বলতে গড়িয়ে যাচ্ছে
আর তারা পাঁচ মিনিট পরে আবার মিলে যায়। ক্লাসিক টক্সিক সম্পর্ক।
আসলে, এটা বেশ রোমান্টিক। চাঁদ এক চুমু খেতে পুরো আকাশ পেরিয়ে এসে সূর্যকে চায়।
আহা, আর আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি তাদের মহাজাগতিক ডেটের তৃতীয় চাকার মতো
সূর্যটাকে কি বিশাল এক নাবিস্কো বিস্কুট এর মতো মনে হচ্ছে, কেউ কামড় দিয়েছে
পুরো ঠিক! আমার এক গ্লাস বিশাল দুধ দরকার সাথে। হয়তো মিল্কি ওয়ে থেকে
ঠিক আছে, গ্রহণ প্রায় শেষ। আমরা কি এখন তালি দিবো?
হ্যাঁ! চাঁদের জন্য সবাই তালি দাও! আবার! আবার!
পরের শো ২০২৬ এ, বন্ধুরা। ক্যালেন্ডারে লিখে রাখ
হে মহাকাশ, আমরা তো শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতার জন্যই এখানে আছি!
শুধু যদি আমাদের অ্যাস্ট্রোনমি মেজর থাকতো… আমাদের এ-প্লাস থাকতো
পরের বার টিকেট বিক্রি করব। ডরমের ছাদে গ্রহণ দেখার টিকেট: পাঁচ ডলার!
আমরা এর নাম দেব… সান-কিসড সিটিং