তানসেন ও বাইজু

তানসেন ও বাইজু

অনেক অনেক দিন আগে মোগল সম্রাট আকবর এর আমলে দিল্লির এক ব্যস্ত শহর আগ্রার রাস্তায় কুচকাওয়াজ সহ উৎসব হতো। সেই উৎসবে গণসংগীত পরিবেশন ছিল নিষিদ্ধ। কারণ উচ্চ স্বরে বেসুরো কণ্ঠ শুনলে পন্ডিতদের সংগীত চর্চায় বিঘ্ন ঘটে। সেই শহরে এক কাফেলা (বিধান না জেনে) গান গাইতে গাইতে শহর অতিক্রম করে; হঠাৎ তাদের উপর হামলায় রতন কুমার বাইজু নামক এক বালক এর বাবা মারা যায়। বাইজুর বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্ব এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে বলে। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে তানসেন সরাসরি যুক্ত না থাকলেও, বাইজু সম্রাটের নবরত্ন তানসেনকেই দোষী মনে করেন। বাইজু বুঝতে পারেন যে এই অবিচারের বিরুদ্ধে তাকে একটা কিছু করতে হবে, কিন্তু কিভাবে তা নিশ্চিত নয়। 

একদিন তিনি নদীর ধার ধরে হাটতে হাটতে মোগল সেনাদের এক শিবির দেখেন। সেখান থেকে বাইজু একটি তলোয়ার চুরি করেন, এবং তা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন এই আশায় যে তিনি তানসেন কে হত্যা করতে এই তলোয়ার টি ব্যবহার করবেন। শিবিরের সৈন্যরা বাইজু কে তাড়া করে এবং শীঘ্রই তাকে ধরে ফেলে। 

ভাগ্যক্রমে এক ত্রাণকর্তা, মনমোহন কৃষ্ণ, সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তিনি বাইজুর পক্ষে মধ্যস্থতা করেন। অবশেষে তাকে তার ডানার নিচে নিয়ে আসেন। পন্ডিত বাইজুকে তার নদীর ধারে গ্রামে নিয়ে যান। যেতে যেতে নৌকার মাঝি, মীনা কুমারী, সুন্দরী গৌরী’র সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। এই বন্ধুত্ব পরে প্রেমে পরিণত হয়।

তারা বেশির ভাগ সময় একসাথে কাটায়। সূর্যাস্তের পর নদীর ধারে বসে গান গাওয়া অনুশীলন করেন। গ্রামবাসী মনে করে এত খুবই কলঙ্কজনক। গৌরির বাবা সেই গ্রামের এক ধনী বেক্তি নরপতি’র সাথে গৌরির বিবাহ ঠিক করেন। বিয়ের পর যখন স্বামী নরপতি আবিষ্কার করে প্রকাশ্যে তারা প্রেমে পড়ছে তখন অসন্তোষ প্রকাশ করে। গৌরির বাবা গৌরী কে বিপথে অগ্রসর হতে নিষেধ করেন। গৌরী অল্প সময়ের জন্য ভয় পায়। পরে ঠিক করে গ্রামবাসীরা যাই বলুক গৌরী বাইজুর হাল ছাড়ছে না।

একদিন ডাকাত রুপমতির আক্রমণে সেই গ্রাম আক্রান্ত হয়। ডাকাতদের লুটপাট বন্ধ করতে বাইজু গান শুরু করে। এই গান তাদের সবার প্রতি মঙ্গল কামনা করে। তাদের নিরুৎসাহিত করে, এবং মানবতা, ও করুনা জাগ্রত করে। বাইজুর গানের দ্বারা কঠোর অপরাধীরা কতটা প্রভাবিত হতে পারে তা দেখে অবাক লাগে। রুপমতি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে যা নিয়েছিল তা এক শর্তে ফেরত দিতে রাজি হয়। রুপমতি বাইজুর প্রেমে পড়ে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বাইজু ইতোমধ্যে গৌরির প্রেমে দিওয়ানা। 

বাইজুর সাথে কথোপকথনের সময় রুপমতি তার অতীত প্রকাশ করে। তিনি একজন ধনী কত্থক শিল্পীর কন্যা যাকে খুন করা হয়েছিল এবং তার জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। রুপমতি তা পুনরুদ্ধার করতে চায় এবং পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়। এই সংবাদে বাইজুর উপলব্ধি হয় যে গৌরীর সাথে সঙ্গীত বিষয়ে মগ্ন থাকার সময় তিনি পিতার কাছে দেয়া নিজের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তারও একটি মিশন পূরণ করার আছে। 

বাইজু রূপমতির কাছ থেকে অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ নিয়ে আগ্রায় চলে যান। রাজসভায় তিনি তানসেনের পিছনে উপস্থিত হন। তার জামার নিচে কোমরে লুকানো একটি খঞ্জর, তা স্পর্শ করতেই তানসেন গান শুরু করলেন, বাইজু  তখন মন্ত্রমুদ্ধ হয়ে পড়েন। যখন তানসেন তার গান শেষ করেন, বাইজুর মোহ ভেঙ্গে যায়। তবে বেশি দেরি হবার পূর্বেই রাজার প্রহরী বাইজুকে বাধা দেন। বাইজু রাজার প্রহরী দ্বারা লাঞ্চিত হন। কিন্তু তানসেন নিজেই দয়ালু। তিনি বাইজুকে মুক্তি দেন এবং তার গ্রামে ফিৱে যেতে দেন। 

বাইজু বুঝতে পারেন যে তানসেন কে শুধু হত্যা করা হবে অপর্যাপ্ত প্রতিশোধ। তানসেন কে অবশ্যই লজ্জিত হতে হবে- তার সংগীতকে বাইজুর থেকে কম দেখানো উচিত। তাই বাইজু তানসেন এর গুরু স্বামী হরিদাস (রায় মোহন) এর শিষ্য হবার জন্যে বৃন্দাবন যান। যে লোক তানসেন কে শিখিয়েছে সেই বাইজুকে শেখাতে পারে। শুধুমাত্র একজন দক্ষ উচ্চ প্রশিক্ষিত বাইজু তানসেন কে পরাজিত করতে পারে। এই পরাজয় মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। 

স্বামী হরিদাস বাইজুকে সহিংসতা পরিত্যাগ করে সহিষ্ণুতা শেখানোর চেষ্টা করেন। প্রতিশোধের প্রয়োজনীয়তা পরিত্যাগ করে বাইজু ধীরে ধীরে তানসেন এর বিরুদ্ধে তার ক্রোধকে সংবরণ করেন। বাইজুর মনে পরে দূরে নদীর ধারে সেই গ্রামের এক নিঃসঙ্গ গৌরির কথা। তার মুখচ্ছবি একমনে ভাবে। নরপতি কে বিয়ে করে গৌরী হয়তো বাইজু কে ভুলে গেছে এতদিনে। রুপমতির কথা মনে পরে, শে বলেছিলো কেউ যদি তানসেনের চেয়ে ভালো গান না করে- গাওয়ার চেষ্টা করে তানসেন এর জল্লাদেরা সেই কারণে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। 

সম্রাট আকবর পরামর্শ দেন যে কেউ গানের মাধ্যমে একটি পাথর গলিয়ে দিতে পারবে সেই জিতবে এই প্রতিযোগিতায়। বাইজু তা করতে সক্ষম হয়। এভাবে সে তার নিজের জীবন বাঁচায় এবং পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেন। তানসেন তার পরাজয় সদয়ভাবে মেনে নেন এবং খুশি হন এই ভেবে যে তার চেয়েও ভালো কেউ আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright © 2024 Educator's Note | Audioman by Catch Themes