প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে | EDM Bangla

প্রমিথিউস থেকে চৈতন্য। সময়টা ছিল ষোড়শ শতাব্দী। বাংলার মাটি তখন মোগল সাম্রাজ্যের ছায়াতলে, কিন্তু এর আধ্যাত্মিক আকাশে ঝড় উঠেছিল আরও অনেক আগে, প্রায় তিনশো বছর আগে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।

সে এক আশ্চর্য সময়। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, পুরোহিত, আর কবি চণ্ডীদাসের দার্শনিক চিন্তাভাবনা বাংলার মাটিকে করেছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের উপর ‘মানুষ সত্য’—এই ভাবনার আলো ফেলেছিলেন যিনি, তিনি হলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য গীতা-ভাগবত পড়া, জানা, বুঝতে পারা ছিল একরকম নিষিদ্ধ। এসব পবিত্র জ্ঞান কেবল সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এক বিশেষ সম্প্রদায়, যাদের শিক্ষা-দীক্ষা পাবার কোনো অধিকারই ছিল না, তারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত ছিল চিরদিন।

তখন চৈতন্য মহাপ্রভু এলেন এক বিপ্লব নিয়ে। তিনি প্রচার করলেন ‘মানব ধর্ম’। তাঁর মন্ত্র ছিল সহজ—লিখতে পড়তে শিখতে জানলে ভালো-মন্দ নিজেই বোঝা যায়। অক্ষরজ্ঞানই হল সেই হাতিয়ার, যা মানুষকে তার অন্তরালিত শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পারে। শিক্ষাই মুক্তির একমাত্র পথ।

তিনিই সেই দরজা খুলে দিলেন। সংস্কৃতের গীতা, ভাগবত, মঙ্গলকাব্য—সবই তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করালেন, প্রচার করলেন। যারা কখনো ভাবতেই পারেনি যে তারা এই পরম জ্ঞানের স্পর্শ পাবে, তারা পেল এক নতুন জীবন। এই কারণেই লোকমুখে কথা ওঠে—চৈতন্য বাংলার অবতার। কারণ, অবকার অর্থই তো তিনি, যিনি মানুষকে মুক্তির সত্যিকার পথ দেখান।

কিন্তু এই তো গেল মানুষের কথা। যারা ক্ষমতায় থাকে, যারা জ্ঞানকে নিজেদের মধ্যে আটকে রেখে স্বর্গসুখ ভোগ করে, তাদের জন্য এই কাজটা ছিল এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। চৈতন্যের এই কাজটাকে দেখানো হচ্ছিল গ্রিক দেবতা প্রমিথিউসের মতো এক মহা-দুষ্কর্মের সঙ্গে তুলনা করে।

সবাই বলাবলি করতে লাগল—প্রমিথিউস যেমন স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিল পৃথিবীর মানুষের জন্য, যাতে তাদের ঠান্ডার কষ্ট দূর হয় এবং আগুনের শক্তিতে তারা সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে, চৈতন্য মহাপ্রভুও তেমনই ‘আধ্যাত্মিক আগুন’—বেদ-পুরাণের জ্ঞান—চুরি করে এনেছেন স্বর্গীয় সংস্কৃতের গর্ভগৃহ থেকে এবং তা বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে, যাতে তাদের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয় এবং তারা জ্ঞানের আলোয় নিজেদের উন্নত করতে পারে।

প্রমিথিউসের শাস্তি হয়েছিল চিরন্তন নির্যাতন। চৈতন্য মহাপ্রভুকেও তার ‘অপরাধ’-এর জন্য একপ্রকার ‘নিখোঁজ’ হতে হয়েছিল এই নশ্বর জগৎ থেকে। চৈতন্য বনাম ব্রাহ্মণ্যবাদ—এটা ছিল এক ধরনের সংস্কারবাদী আন্দোলন, যা পুরনো ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।

এবং যুগ চলল…

কালস্রোত বয়ে চলল। প্রায় আরও তিনশো বছর পর, আঠারোশো শতাব্দীতে দেখা গেল আরেক আশ্চর্য কাহিনি। হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তার প্রেমিকা-স্ত্রী শান্তিমাতা। অনেকের কাছেই তারা ছিলেন রাধা-কৃষ্ণের আরেক রূপ, মানবরূপী দিব্য প্রেমের সংস্করণ (আরেক সংস্করণ)।

তাদের জীবনী লিখেছিলেন অশ্বিনী কুমার গোসাই, যিনি পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেছিলেন এবং তাদের জীবনের বিস্ময়কর পান্ডুলিপি তাঁকে দেখিয়েছিলেন। অশ্বিনী গোসাই দাবি করেছিলেন, হরিচাঁদ ঠাকুর ও শান্তিমাতা ছিলেন none other than চৈতন্যদেবেরই অবতার।

কেন এলেন তারা? কথিত আছে, তারা এলেন পূর্বজন্মের—চৈতন্যের জন্মের—অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে। যে কাজটি যুগে যুগে, জন্মে জন্মে, অবতার after অবতার আসেন শুধু একটি Message দিতে—মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে। কারণ, মুক্তির সেই মশাল কখনও নেভে না। এক হাত থেকে আরেক হাতে চলে যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

Copyright © 2025 Note | Audioman by Catch Themes