কোনো দেয়াল ছিল না, তবু দুটি সম্প্রদায় ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। একদিকে, পশ্চিম তীর—উন্নতির প্রতীক, যেখানে শিক্ষা, ব্যবসা, ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছিল। অন্যদিকে, পূর্ব তীর—এক বিভ্রান্তির ঘূর্ণিতে বন্দি, যেখানে কেউ ওপরে উঠতে চাইলে, বাকিরা তাকে নিচে নামানোর আনন্দে মেতে উঠত।
এই অদ্ভুত সংকীর্ণতার মূল ছিল হাইড্রা, এক রহস্যময় সত্তা, যাকে কেউ পুরোপুরি দেখেনি, কিন্তু তার অস্তিত্ব সবাই অনুভব করত। গল্প ছিল, হাডসন নদীর ধোঁয়াশার নিচে সে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু তার ছায়া এখনও মানুষের মনে কাজ করে। সে কখনো একজন বন্ধুর মুখে, কখনো একজন পরামর্শকের রূপে, আবার কখনো আত্মীয়ের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তার ক্ষমতা ছিল—মানুষকে বিভক্ত রাখা, একে অপরের পেছনে লাগিয়ে দেওয়া, এবং নিজস্ব সম্প্রদায়কেই ধ্বংস করার মন্ত্র প্রয়োগ করা।
অভিশপ্ত পূর্ব তীর
বহু বছর আগে, পূর্ব তীরের এক তরুণ—রাশেদ—নদী পার হয়ে পশ্চিম তীরে গিয়েছিল। সেখানে সে স্বীকৃতি পেয়েছিল, শিক্ষা পেয়েছিল, নিজের প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু যখন সে ফিরে এল, পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে, তখনই হাইড্রার ছায়া নেমে এল তার উপর।
“তুমি আমাদের মধ্যে থেকেও আমাদের নও,” বলল তার পুরনো বন্ধুরা।
“তোমার উন্নতি আমাদের লজ্জা দিচ্ছে,” বলল আত্মীয়রা।
“যে এগিয়ে যেতে চায়, সে শত্রু,” ঘোষণা করল প্রবীণরা।
রাশেদ বুঝতে পারল, হাইড্রার অভিশাপ কেবল এক অলৌকিক কাহিনি নয়, বরং এটি ছিল একটি মানসিকতা—যা পূর্ব তীরের মানুষদের নিজেদেরই শত্রু করে তুলেছে।
সেতুর স্বপ্ন
অনেক বছর পর, আরাফাত নামে এক যুবক হাডসন নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখল। সে চেয়েছিল, দুই তীরের মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে, যেন পূর্ব তীরের মানুষও শিক্ষা ও উন্নতির সুযোগ পায়।
কিন্তু যখন নির্মাণ কাজ শুরু হলো, অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। শ্রমিকরা একে অপরকে বিশ্বাস করছিল না, কেউ কেউ বলছিল, “এই সেতু আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।” রাতের আঁধারে কেউ কাঠামো ভেঙে দিচ্ছিল, কেউ কেউ হুমকি দিচ্ছিল আরাফাতকে।
এক রাতে, কুয়াশাচ্ছন্ন হাডসন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, আরাফাত দেখল—জলের মধ্যে অসংখ্য ছায়া নড়ছে। সেই ছায়া থেকে ধীরে ধীরে এক বিশাল মুখের অবয়ব ফুটে উঠল—হাইড্রা।
“তুমি কি ভাবো, আমার অভিশাপ ভাঙবে?” নদীর গর্জনের মধ্যে গা ছমছমে কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
“তোমারই লোকেরা তোমার সর্বনাশ করবে। তারা তোমাকে বিশ্বাসঘাতক বলবে, তোমার স্বপ্নকে আগুনে পুড়িয়ে দেবে। দেখো, কীভাবে তোমার আপনজনরাই তোমাকে ধ্বংস করবে!”
শেষ পরিণতি
সেই রাতেই আগুন লাগল সেতুর কাঠামোতে। পূর্ব তীরের কিছু লোক, যারা পরিবর্তন চায়নি, তারা মশাল হাতে এসে সেতুতে আগুন দিল। “আমরা পশ্চিম তীরের দাস হব না!” চিৎকার করল কেউ।
আরাফাত বুঝল, হাইড্রা আসলে এক অদৃশ্য শক্তি, যা মানুষের মনেই বাস করে। এটি বিভেদ সৃষ্টি করে, সফলতাকে অপরাধে পরিণত করে, পরিবর্তনকে ভয় ধরিয়ে দেয়।
পরদিন সকালে, নদীর ধোঁয়াশার মধ্যে হাইড্রার ছায়া আবার মিলিয়ে গেল, যেন কিছুই হয়নি।
চিরস্থায়ী বিভাজন
আরাফাত চলে গেল, আর কখনো ফিরে এল না।
পশ্চিম তীর এগিয়ে চলল—নতুন সুযোগ, নতুন প্রজন্ম, নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলল।
পূর্ব তীর? তারা আজও হাইড্রার ছায়ার নিচে বসবাস করে, নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে, নিজেদের উন্নতির শত্রু হয়েই বেঁচে থাকে। তারা জানে না, হাইড্রা নেই, অভিশাপ নেই—শুধু তাদের নিজেদের মানসিকতা তাদের চিরকাল পেছনে ফেলে রেখেছে।